ভোটের আগে নতুন করে আবার ‘বর্গী’ এল বাংলায় দেখুন কি ভাবে, বহিরাগতে ভয় না পেলেও আমরা ‘বর্গী’দের ভয় পাই। রাজনীতির ময়দানে বিজেপি ‘প্রীতি’কে বিজেপি ‘ভীতি’তে বদলাতেই কি ‘বর্গী’ আনল তৃণমূল?
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ‘বহিরাগত’ থিম রাজনৈতিক বিতর্কের অন্যতম বিষয় হয়ে উঠছে। তবে রাজ্যের বিপুল সংখ্যক অবাঙালিভাষী ভোটার সম্পর্কে অবশ্য সতর্ক ক্ষমতাসীন অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দুই শিবিরই।
তবে এবার আর শুধু ‘বহিরাগত’ নয়। পদ্মশিবিরকে ‘বর্গি’ নামেই ডেকে আক্রমণ জারি রেখেছে তৃণমূল। তবে এই শব্দটি বাংলার ইতিহাসে এবং সাহিত্যে কিন্তু বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ বহন করে।
তৃণমূল নেতা সুখেন্দু শেখর রায় সম্প্রতি বলেছিলেন, “এটি একটি ভুল ধারণা যে আমাদের দল বিজেপিকে ‘বহিরাগত বলে অভিহিত করছে। বরং আমরা তাদের বহিরাগত ‘বর্গি’ বলছি। এই শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ”। তৃণমূল নেতা কোন অর্থে বলেছেন তা আমাদের জানা না থাকলেও। এই শব্দের তাৎপর্য ঠিক কতটা তা একবার দেখে নেওয়া যাক-
‘বর্গি’ আসলে আমাদের খুব পরিচিত শব্দ হলেও এর উৎস আমরা সঠিক জানি না। ইতিহাস বলে, এই শব্দটি পশ্চিমবঙ্গে ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি মারাঠা আক্রমণের প্রসঙ্গে বাংলা ভাষায় স্থান পায়। সেই সময় বাংলায় মোগল আধিপত্য ছিল প্রবল। মোগলদের মধ্যে যারা লুটপাট, লুণ্ঠন ও গণহত্যা করত তাঁদের এই নামেই ডাকা হত। বাংলা সাহিত্যে এবং লোককাহিনীতে ‘বর্গি’দের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই ‘বর্গি’ আসলে কারা?
বর্গি শব্দটি কিন্তু ভারতে প্রথমে মারাঠি ভাষা থেকে এসেছে। মোগল সেনাবাহিনীর অশ্বারোহীদের বর্গি বলা হত। যদিও এর উৎপত্তি ফরাসি শব্দ ‘বার্গির’ থেকে। যার আক্ষরিক অর্থ ‘বোঝা নেওয়া’ বা ‘যিনি বোঝা নেন’। ইতিহাসবিদ সুরেন্দ্র নাথ সেন ১৯২৮ সালে তাঁর লেখা “দ্য মিলিটারি সিস্টেম অফ দ্য মারাঠাস” বইতে এই শব্দের আভিধানিক অর্থ তুলে ধরেন। যদিও মোগল কিংবা মারাঠা সেনাবাহিনীতে এই শব্দটিকে বোঝানো হয়, “এক সৈনিক যিনি সুসজ্জিত ঘোড়ায় চড়ে লুন্ঠনে বেরিয়েছেন’।
বাংলায় এই শব্দটির প্রচলন হল কবে থেকে?
বাংলা সেই সময় ছিল বাংলা-বিহার-ওড়িশা একযোগে। যা আমরা অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ হিসেবে ইতিহাসে পড়ে থাকি। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সেই সময় বাংলায় মোগল আধিপত্য ছিল প্রবল। আর তখনই বাংলা আক্রমণ করেছিল মারাঠা বর্গিরা। প্রতিপত্তি স্থাপনে নয়, কেবল লুটতরাজ করতেই হামলা চালায় তারা। সেই সময় বাংলায় মোগল সুবাদার সরফরাজ খাঁ-কে ক্ষমতাচ্যুত করে আসনে আসেন আলিবর্দি খাঁ। যদিও সেই সময় ওড়িশার গভর্নর জাফির খাঁ রুস্তম জং, যিনি পরিচিত ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ (দ্বিতীয়) নামে। আলিবর্দিকে আসনচ্যুত করতে হাত মেলান মারাঠা রাজ রাঘোজি ভোঁসলের সঙ্গে।
বর্গি আক্রমণে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলা?
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় ১৭৪১ সালের অগাস্ট মাসে প্রথম মোগল অঞ্চলে হানা দেয় মারাঠিরা। ওড়িশা দখল দিয়ে শুরু হয়েছিল যাত্রা। যদিও আলিবর্দী খাঁ-এর কাছে পরাস্ত হয় তারা। ১৭৪৩ সালে বাংলায় ফের মারাঠি সেনা প্রবেশ ঘটে।
রাঘোজি এবং নানাসাহেব দুই নেতার দুই দল আসে বাংলা দখলে। যদিও বুদ্ধির বলে দুই নেতার মধ্যে অশান্তি লাগিয়ে দেন আলিবর্দী এবং পেশোয়ারে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। তবে অনেক নথি থেকে জানা যায়, বাংলা দখল নয় লুন্ঠনে আসে ওই দুই মারাঠি নেতা। ১৭৫০ সালে ফের মুর্শিদাবাদে আক্রমণ চালান রাঘোজি। সেই সময় সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল বাংলার রাজধানীকে।
১৭৫১ সালে যখন রীতিমত বাংলায় আসর জমাচ্ছে মারাঠি সৈন্যরা, সেই সময় আলীবর্দি খাঁ একটি চুক্তি সারলেন তাঁদের সঙ্গে। বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা এবং ওড়িশার ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি দিলেন রাঘোজিকে। কিন্তু এর বিনিময়ে বাংলায় আক্রমণ করা যাবে না, তাও সাফ জানান হয়।
কিন্তু দশ বছর ধরে বর্গি আক্রমণে বাংলার অর্থনীতি তখন ভাঙ্গাচোরা একটি কাঠামো। ঐতিহাসিক পি জে মার্শাল তাঁর বই বেঙ্গল: দ্য ব্রিটিশ ব্রিজহেড: ইস্টার্ন ইন্ডিয়া-তে লিখেছেন, “বাংলায় বর্গি হানায় প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাঁত, রেশম ও তুঁত চাষে ক্ষয়ক্ষতি ছিল সবচেয়ে বেশি। বীরভূমের মত গ্রাম তৈরি হয়েছিল মন্বন্তর।”
আঠারো শতকের বাংলা পাঠ্য ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’-এ এই আক্রমণের একটি দিক তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়, “আক্রমণকারীরা চিৎকার করে বলতে লাগল আমাদের টাকা দাও, টাকা দাও। কিন্তু যখন টাকা পেল না, তখন অত্যাচারের শেষ সীমা অতিক্রম করল। নাক দিয়ে জল টানিয়ে মারতে লাগল লোকেদের। কাউকে ডুবিয়ে দিল জলের ট্যাঙ্কে। কাউকে মারা হল শ্বাসরোধ করে। প্রাণের বিনিময়ে অর্থ দিলে তবেই ছিল মুক্তি।”
বাংলা সাহিত্যে বর্গিরা এল কীভাবে?
বহু শতাব্দী ধরে বর্গি আক্রমণের সেই ইতিহাস আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রবেশ করে অচিরেই। আঠেরো শতাব্দীর বর্গি হানাকে গণহত্যা হিসেবেই দেখা হল সাহিত্যে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, “আজ আমরা এই শব্দ ব্যবহার করে বাইরে থেক আগত সেই সব লুঠতরাজ চালনাকারীদের বলি যারা রাজ্যের ক্ষতি করে থাকে।”
তবে ‘বর্গি’ যে ভীতির আরেক নাম তা আমাদের শিখিয়েছে আমাদের ছোটবেলা। তা সে জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’র- ‘পারুল বোন ডাকে চম্পা ছুটে আয়/ বর্গীরা সব হাকে কোমর বেঁধে আয়’, কিংবা যখন মা-ঠাকুমারা বলতেন, “খোকা ঘুমালো, পাড়া জুরালো, বর্গী এলো দেশে / বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?” তাই বহিরাগতে ভয় না পেলেও আমরা ‘বর্গী’দের ভয় পাই। রাজনীতির ময়দানে বিজেপি ‘প্রীতি’কে বিজেপি ‘ভীতি’তে বদলাতেই কি ‘বর্গী’ আনল তৃণমূল?#